ময়ূর পালন
আদিমকাল থেকে মানুষ নিজেদের খাদ্য তালিকায় পাখির ডিম ও মাংসের সংযোজন করে আসছে। রসনা তৃপ্তির পাশাপাশি সৌন্দর্য্য পিয়াসী মানুষ নানা জাতের পাখিও সেই আদিকাল থেকে পালন করে থাকে। পাখি পালনের সাথে সাথে মানুষ অর্থনৈতিক দিক থেকেও উপকৃত হতে থাকে। মানুষ নিজেদের খাদ্য চাহিদা, শখ ও মনোরঞ্জনের জন্য পাখিকে নিজ আয়ত্বে রাখার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এরই ধারাবহিকতায় অনেক পাখিই মানুষের পোষ মেনেছে। পালক বিশিষ্ট দ্বিপদ প্রাণিকে পাখি বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, পাখি হচ্ছে ওড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ডানাওয়ালা মেরুদন্ডী প্রাণি যাদের পরিবেশের সাথে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে। পোল্ট্রি যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। পোল্ট্রি হচ্ছে মূলতঃ ঐ সমস্ত পাখি যারা মানুষের তত্বাবধানে থেকে ডিম পাড়ে ও বাচ্চা উৎপাদন করে এবং অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা প্রদান করে। হাঁস, মুরগি, কবুতর, তিতির, কোয়েল এবং টার্কির মত ময়ূরও পোল্ট্রি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। পোল্ট্রি বিজ্ঞান এসব বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা অব্যাহত রেখেছে। তাই পোল্ট্রি শিল্প আজও এতো লাভজনক ও আকর্ষণীয়। পোল্ট্রি ছাড়া অন্যান্য পাখি নিয়েও দেশে-বিদেশে গবেষণা চলছে যা অরনিথলজি হিসাবে পরিচিত। এর মাধ্যমে নতুন নতুন পাখি পোল্ট্রি হিসাবে স্বীকৃতি পাবার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে।
পোল্ট্রি শিল্পে ময়ূর:
বর্তমানে লেয়ার, ব্রয়লার ও হাঁসের খামার সকলের নিকট পরিচিত। পোল্ট্রি বলতে অনেকেই শুধু মুরগিকে বোঝেন, আসলে কিন্তু তা ঠিক নয়। বাণিজ্যিক না হলেও পারিবারিক বা শখের বশে আমাদের দেশে কবুতর, তিতির, রাজহাঁস, মাসকোভী হাঁস ও কোয়েল পালিত হয়ে থাকে। কিন্তু ময়ূর একটি লাভজনক পেশা হওয়া স্বত্বেও আমাদের দেশে এ পাখিটিকে চিড়িয়াখানা ছাড়া অন্য কোথাও পালন করতে দেয়া যায় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ময়ূর বাণিজ্যিকভাবে পালন করা লাভজনক এবং গ্রামে-গঞ্জেও পালন করা যেতে পারে। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে, বাড়বে আয়- রোজগারের পথ এবং উন্নতি হবে দেশ ও দশের।
ময়ূরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
বাংলাদেশে সুন্দরতম পাখি ছিল ভারতীয় ও বর্মী ময়ূর। এ প্রজাতি দু’টি বর্তমানে দেশে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ময়ূর যেমন সুন্দর পাখি তেমনি এদের অপূর্ব সুন্দর পেখম সকলকে বিমোহিত ও আকৃষ্ট করে। ময়ূরের মাংস বেশ সুস্বাদু ও স্বাস্থকর। যেহেতু এদের মাংস বাজারে বিক্রি হয় না সেহেতু তা পাওয়া গেলেও বাজারে মূল্য হবে অত্যধিক। রসনা তৃপ্তির জন্য এদের মাংসের চাহিদা আছে দেশে। এই প্রেক্ষাপটে কবুতর, মুরগি, কোয়েল ও হাঁসসহ অন্য যে কোনো পোল্ট্রির ন্যায় ময়ূর পালনও অবশ্যই লাভজনক। ময়ূরের পালক সবার কাছেই অত্যন্ত সমাদৃত। যারা কোনোদিন ময়ূর দেখেনি তারাও এদের পালকের খুব ভক্ত। মৎস্য শিকারীরা সেই যুগ যুগ ধরে আগে থেকে মাছ ধরার ছিপের সাথ ময়ূরের পালক ব্যবহার করে থাকেন। দেশে-বিদেশে ময়ূরের পালকের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে।
দেশে ময়ূরের বর্তমান অবস্থান:
ময়ূরের পালকের প্রচুর জনপ্রিয়তা থাকার জন্য দেশের বহু অভিজাত দোকানে এদের পালক বিক্রি করা হয়ে থাকে। কিন্তু তাই বলে মনে করা যাবে না যে দেশে ময়ূরের সংখ্যা রয়েছে যথেষ্ট। দেশে বিদ্যমান চিড়িয়াখানাগুলো ছাড়া আসলে ময়ূর দেশের অন্য কোথাও সাধারণত দেখা যায় না। শোনা যায়, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন বনে কদাচিৎ বর্মী ময়ূরের দেখা মিলে। এমনও এক সময় ছিল যখন ময়ূর ঢাকা জেলার শালবন থেকে ময়মনসিংহ, ভারতের মেঘালয় ও আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচরণ করতো। বাংলাদেশে এ মূল্যবান পাখিটি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ভারতে যথেষ্ট সংখ্যক ময়ূর পাওয়া যায়। ময়ূর ভারতের জাতীয় পাখি এবং ভারতীয় হিন্দুরা ময়ূরকে কার্তিকের বাহন হিসাবে পূজা করে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ময়ূর লালন-পালনের উপযোগী। কিন্তু বর্তমানে তা শুধুমাত্র চিড়িয়াখানা ও বিত্তবানদের পাখি হিসাবে পরিচিতি লাভ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পাখিটি গ্রামের হত-দরিদ্র মানুষ থেকে অনেক পরিবারই স্বাচ্ছন্দ্যে লালন-পালন করতে পারেন।
ময়ূরের বৈশিষ্ট্য:
এদের দেহে উজ্জ্বল সবুজ ও নীলাভ পালক থাকে। মাথা, ঘাড়, গলা এবং ডানার পালক কিছুটা নীলাভ। ডানার বাকি অংশ লালচে। পা লালচে। ময়ূরীর পেখম নেই কিন্তু ময়ূরের রয়েছে অপূর্ব আকর্ষণীয় পেখম। ময়ূরের সবুজ পেখমের পালকে অনেকগুলি বড় চৌকাকৃতি ফোঁটা থাকে যা খুবই আকর্ষণীয়। পেখমগুলি লেজের পালক নয়-ওগুলি লেজের গোড়ার উপরের পালক যা অতিমাত্রায় লম্বা। ময়ূরের চূড় আছে। ময়ূর পিঠের উপর পেখম তুলে ডানা ঝুলিয়ে নেচে নেচে ময়ূরীকে আকর্ষণ করে যা নয়ন মনোহর ও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক।
ময়ূরের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য:
ময়ূর দলবদ্ধভাবে বনে-জঙ্গলে বিচরণ করে। ৫-৬টি ময়ূরীর সাথে এক এলাকায় ১টি ময়ূর থাকে। এরা মাটিতে চলাফেরা করলেও বেশিরভাগ সময় বড় গাছের ডালে থাকে। শস্যদানা, কীটপতঙ্গ, সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি এদের প্রিয় খাদ্য। মাটিতে সামান্য গর্ত করে ৩ থেকে ৫টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলি ধুসরাভ। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ২৭-৩০ দিন সময় লাগে। এদের গড় আয়ু প্রায় ৩৫ বছর। ময়ূরের যৌবনপ্রাপ্তি ঘটে সাধারণত ৩-৪ বছরে।
আবদ্ধ অবস্থায় লালন-পালন:
আবদ্ধ অবস্থায় লালন-পালনের ক্ষেত্রে এদেরকে নিয়মিত গম, ধান, সবজি, বীজ ইত্যাদি খেতে দিতে হয়। পেঁপে, তরমুজসহ অন্যান্য পাকা ফলও এদের প্রিয় খাদ্য।দৈনিক খাদ্য তালিকা (মাথাপিছু) সেই সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
ময়ূর পালনে করণীয়:
প্রকৃতির সুন্দরতম পাখিটিকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকলের। বর্তমানে বনভূমির সঙ্কোচন ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য প্রাণিকূলের ন্যায় ময়ূরের স্বাভাবিক সংখ্যাও সীমিত হয়ে এসেছে। এমতাবস্থায় এদেরকে রক্ষার জন্য সর্বাত্নক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা আবশ্যক। বন্যপ্রাণি রক্ষার জন্য দেশে বেশ কয়েকটি “বনকে” ময়ূর প্রতিপালনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য চিহ্নিত করা যেতে পারে। এজন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে ময়ূর সংগ্রহ করে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যায়। এছাড়াও সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে স্বতন্ত্রভাবে ময়ূর পালনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট গ্রাম/ইউনিয়ন/থানা এলাকায় পাইলট প্রকল্প হিসাবে ময়ূর পালনে আগ্রহী মানুষকে উদ্যোগী করে প্রশিক্ষিত করে তোলা যেতে পারে। দেশে ময়ূর পালন, রক্ষণাবেক্ষণ, বাজারজাতকরণ, ময়ূরকেন্দ্রিক কুটির শিল্প স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, ভোকেশনাল ইনসটিটিউটসমূহে প্রশিক্ষণের সুযোগ-সবিধা সহজেই সৃষ্টি করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারী পৃষ্টপোষকতা থাকলে এ শিল্পেরও উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে। পোল্ট্রি শিল্পের ক্ষেত্রে উদীয়মান দেশ হিসাবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সুনাম অর্জন করেছ। বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক মুক্ত বাজারে নতুন নতুন পণ্য সৃষ্টি, বিপণন ও বাজার চালুর সম্ভাবনাময় খাতকে উন্মোচিত করার সময় এসেছে। তাই এই শিল্পের প্রসার ও উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো।